ইতালিয়ান কবি দান্তে (বার্ট এর তালিকায় দ্বিতীয়) মধ্যযুগে বসে একেশ্বরবাদী তিনটি ধর্মের পৌরাণিক পরকাল স্বর্গ ও নরকের যে চিত্র অঙ্কণ করেছেন তার উচ্চতা আজ পর্যন্ত কোনও কবি বা সাহিত্যিক বা প্রাবন্ধিক বা পাদ্রি অতিক্রম করতে পারেননি। ইংরেজ কবি মিল্টন তাঁর মহাকাব্য প্যারাডাইস লস্ট এ এই ধর্মগুলির আর একটি পৌরাণিক কাহিনী আদম ও হাওয়ার স্বর্গচ্যুতির এক অতুলনীয় গল্প রচনা করেন।
আদম-হাওয়ার আত্মার বিশুদ্ধতার অধিকার গ্রহণ নিয়ে ঈশ্বর আর শয়তানের প্রতিযোগিতা-গাথায় মিল্টন এমন এক ন্যারেটিভ টেনে এনেছেন যা পড়ে এ দুজনের মধ্যে কে আসল হিরো তার সিদ্ধান্তে আসা দুষ্কর বলে অনেকে মত দিয়েছেন। নাস্তিক কবি শেলি শয়তানকেই আসল হিরো রূপে চিহ্নিত করেছেন। তবে মিল্টনের যুগে ঈশ্বরের পক্ষে অবস্থান না করে কোনও উপায় ছিল না, যখন তাঁর ইতালিয়ান বন্ধু বিজ্ঞানি গ্যালিলিও পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলির এই মতবাদের সাথে সহমত পোষণ করে আর ক্ষমা চেয়ে পাদ্রিদের হাত থেকে জীবন রক্ষা করেন।
হোমার, দান্তে, ভিরগিল (ইংরেজি উচ্চারণ ভার্জিল) এর মহাকাব্যগুলি আর খ্রিস্টীয় পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল মুখস্ত করা মিল্টনের পদ্যে হিরোর মাহাত্ম্যের চেয়ে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের মাহাত্ম্যকে উপরে টেনে আনা হয়েছে।
মিল্টনের দ্বিতীয় প্রধান কাব্য গ্রন্থ প্যারাডাইস রিগেইনড এর বিষয়বস্তু হল শয়তানের ধোকার উপর জিশু খ্রিস্টের বিজয়।
মিল্টন প্রথম জীবনে লিসিডাস নামক এক শোকগাথা রচনা করে নাম করেন। তিনি ধনী পিতার সন্তান ছিলেন। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। তাঁর সময়টা ছিল ইউরোপীয় পূনর্জাগরণ আর আধুনিক যুগের মেলবন্ধন। ব্রিটিশ গৃহযুদ্ধের কাল। গণতন্ত্রীরা ১৬৪৯ সালে ইংরেজ রাজ প্রথম চার্লস এর গর্দান কেটে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর মিল্টন অলিভার ক্রমওয়েল এর অধীনে সরকারি উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬৬০ সালে প্রথম চার্লস এর পুত্র দ্বিতীয় চার্লস বিলাতের রাজতন্ত্র ফিরে পান। মিল্টন চাকরি হারান আর কিছু দিনের জন্য জেলেও যান।
চাকরিচ্যুতি মিল্টনের জন্য অবারিত সুযোগ নিয়ে আসে সাহিত্য সাধনার, অনেকটা বার্ট এর তলিকার পঞ্চম সাহিত্যিক চ’চারের মতো। আর মিল্টন লেখেন ইংরেজি ভাষায় এ যাবৎ রচিত (প্রায় সকল পন্ডিতের মতে) শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য প্যারাডাইস লস্ট। যা ধর্মীয় উপকথা ছাড়াও লিপিবদ্ধ করে মানুষের দুরবস্থার এক অবিস্মরণীয় কাহিনী। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সাধারণত যে কবি বা গল্পকার মানুষের অবস্থা, যাকে ইংরেজিতে বলে হিউম্যান কন্ডিশন, যত নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পারেন আখেরে তিনিই তত জনপ্রিয় আর বিখ্যাত হন।
মধ্য যুগের ইংরেজিতে লেখা শেক্সপিয়ার বা চ’চারের মূল গ্রন্থগুলি আধুনিক পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য হলেও মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট আর প্যারাডাইস রিগেইনড তেমনটা নয়।
ইউরোপিয়ান ভাষাগুলির পন্ডিত মিল্টন তিনটি বিয়ে করেন। ৪২ বছর বয়স থেকে তিনি অন্ধ হয়ে যেতে থাকেন। যখন প্যরাডাইস লস্ট লেখেন তখন তিনি পুরোপুরি অন্ধ| অন্ধ জীবনে তাঁর মেয়েরা তাঁকে লেখালেখিতে সাহায্য করেন। ৬৬ বছরের জীবন অতিক্রম করে মিল্টন ১৬৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তবে বাতে না ক্ষয়রোগে, এ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে।